বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪
সম্পূর্ণ খবর
দেবস্মিতা | ১২ নভেম্বর ২০২৪ ১৫ : ৩৫Debosmita Mondal
অভি চক্রবর্তী
বাংলা নাট্যের মৌলিক নাটক - রচনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং বিচিত্র স্তম্ভ মনোজ মিত্রের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ নাটকের মহল। স্বাভাবিক। যে মানুষ বাতিল, বুড়ো, একলা, নির্জন মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে লড়ে গেলেন আজীবন, ডুয়েল লড়ে গেলেন স্বয়ং যমের সঙ্গে জীবনের বুড়ো বেলার প্রতিনিধি হয়ে, সে মানুষ আজ চলে গেলেন। জীবনের নিয়মে। কিন্তু থেকে গেলেন তাঁরই সৃষ্ট বিবিধ চরিত্রের মধ্যে দিয়ে...
সম্প্রতি অশোকনগর নাট্যমুখ থেকে তাঁর 'সাজানো বাগান' নাটকটি মঞ্চস্থ করেছি আমরা। নাটকটি তৈরির সময়ে ভাবছিলাম, বাঞ্ছাকে আনতে হচ্ছে কেন আবার? আদৌ কি এই থিয়েটারের আর প্রয়োজন আছে? তাহলে কি আজ এত বছর পরেও বাগানকে সাজিয়ে রাখতে দিচ্ছে না আজকের নকড়ি-ছকরিরা বা তাদের পরম্পরা হোৎকা, কোৎকারা?
নাটক পড়তে গিয়ে, এই সময়ের তন্দুরে প্রত্যহ রোস্ট হতে হতে মনে হচ্ছিল, না বাঞ্ছাকে ফিরে আসতে হচ্ছে, হবেই। যশোর রোডের দু’পাশে গাছ কেটে দিচ্ছে কারা? গাছকাটা বিরোধী আন্দোলনে জড়ো হচ্ছে যারা, তাদের সন্মুখে কি লাঠি হাতে বাঞ্ছাই দাঁড়িয়ে নেই? যুগান্তরের প্রতিনিধি হয়ে? ফলত নাটকের নাম বদলে নিতে হল নাটকের। নির্জন একলা মানুষকে সামনে এনে একক লড়াইকে মুখ্য করে তুলতে নাটকের নাম 'আবার বাঞ্ছা' করলাম।
নাটকটির এক জায়গায় নকড়ি গোবিন্দ ডাক্তারকে বলে, 'তোর গুরুভাইরা কোলকাতায় রোগী মারে না? ' আমি হতবাক হয়ে যাই? আজও এই গুরুভাইরা সমান তালে সচল। মোক্তার যে বশীকরণে বাঞ্ছাকে মারতে চায়, তার বিবিধ পোস্টার আমরা আজও ট্রেনে উঠলেই দেখি। গুপিকে সুপারি দেয় নকড়ি, বাঞ্ছাকে মারতে হবে তার... মঞ্চে টাকা ওড়ে... খবরের কাগজ খুললে এমন সুপারি দেওয়ার ঘটনায় মাথা ঝিম হয়ে আসে আমাদের, আজও। তাই বাঞ্ছাকে আসতে আসতে দাঁড় করাই আমরা, লাঠি তুলে দেই নকড়ির হাতে। নকড়ি নুইয়ে পরে। বাঞ্ছা উঠে দাঁড়ায়। প্রান্তিকতা আর প্রতিষ্ঠানের অদলবদল করবার এক সূক্ষ চেষ্টাই এই থিয়েটারের মধ্যে লেপ্টে আছে। সে কথা বিশদে বলব অন্যত্র।
নারায়ণ গোস্বামী, অশোকনগরের বিধায়ক, কথায় কথায় একদিন জানালেন বাঞ্ছা চরিত্রের প্রতি তাঁর আগ্রহের কথা। এই চরিত্রের সঙ্গে যাপনের কথা। সেখান থেকেই এ নাট্যের প্রাথমিক পরিকল্পনা হলেও, প্রতিটি মহলাই এ নাট্যের এখনও আমাকে তাজ্জব করে। থিয়েটারে এই প্রথম আমার একেবারে রিয়েলিস্টিক নাটককে অ্যাপ্রোচ করা। নারায়ণদা না বললে আমি করতাম না। মনোজদার পাঠক হিসেবে, তাঁর নাট্যের দর্শক হিসেবে থেকে যেতাম। তাঁর আড্ডার সঙ্গী, তাঁর যাত্রার সঙ্গী হিসেবেই থেকে যেতাম। সেক্ষেত্রে নারায়ণদাই নাট্যমুখের সঙ্গে, মনোজদার সঙ্গে আমার পাঠে- মঞ্চের সংশ্লেষ ঘটালেন।
আজ এই নাট্যের চতুর্থ অভিনয়। স্বরূপনগরে। আমরা জানি, মানুষ আবার আজ এই নাটকের অন্তরে, অন্দরে কৌতুকের যে মহানগর নির্মিত আছে তাতে উদ্বেলিত হয়ে উঠবে। পদ্মর প্রতিবাদে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখে উঠে দাঁড়াতে চাইবে। বাঁধতে চাইবে জোট, ছাড়তে চাইবে কন্ঠ। রক্ষা করতে চাইবে তাঁর জ্যোৎস্না, তাঁর চিলেকোঠা, তাঁর ক্ষীণকায়া নদী, তাঁর ছোট্ট বাগানখানি। আর মনোজ মিত্র এক, একলা পরিব্রাজকের মতো, ঠোঁটের কোণায় ঝোলানো হাসি নিয়ে ঘুরে আশ্রয় দিয়ে যাবেন এইসব মানুষদের। যতদিন থিয়েটার থাকবে ততদিনই।